স্বাধীনতা দিবসে শহীদ ডা. আব্দুল আলীম কন্যার বাবাকে নিয়ে লেখা

ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির ফর্ম ফিলাপের দিন,বাবার নাম আর হলের নাম দুই ঘরেই একই নাম লিখলাম- শহীদ ডাঃ আলীম চৌধুরী। যেই ক্যাম্পাসে বাবা পড়েছে, তার নামে হলের নাম দেয়া হয়ছে যেখানে, সেই ক্যাম্পাসে কাটানো সময়গুলো এখনো স্বপ্নের মত মনে হয়।

আমার জীবনের প্রথম স্মৃতিগুলো বেশ ভয়ের। একাত্তরে আমার বয়স ছিল তিন বছর, বাইরে বোম ব্লাস্টের শব্দ, হঠাৎ বেজে ওঠা সাইরেন, এগুলো শুনে প্রচন্ড ভয় পেতাম। ঝাপসা ভাবে মনে পড়ে, সেই সময় জানালার পাশে দাঁড়ানো বাবার মুখটা,স্মৃতি-বিস্মৃতির আড়ালে আবছা একটা ছবি। সেই ঝাপসা মুখটা পরম নির্ভরতা দিত সে সময়। সাইরেন শুনে ভয়ে যখন লুকাতাম, বাবা নাকি বলতেন,” ভয়কে মেরে দিয়েছি তো, ভয়ের কিছু নাই মা”।সেই নির্ভরতার জায়গাটা, বাবার কোলের সেই শান্তির আশ্রয় হারিয়েছি ছোটবেলাতে। বাবার আর আমার ছবিটা যখন দেখি,প্রচন্ড কষ্ট হয় তখন। তাকাতে পারিনা ছবিটার দিকে। তখন আমি আর এই মধ্যবয়স্কা নীপা থাকিনা, তিন বছরের ছোট মেয়েটা হয়ে যাই,ভয়ের সময় যে খুজে ফেরে বাবার কোল।

ছোট থেকে জেনে এসেছি, বাবা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। তবে ব্যাপারটা যে কত গর্বের, তার উপলব্ধি হয়েছে আরো পরে। বেড়ে ওঠার সময়টা খুব একটা সুখকর ছিলনা আমাদের। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্বাচ্ছন্দে কথা বলা যেতনা খুব একটা। বাবার ঘাতক, সেই তথাকথিত মাওলানা মান্নানকে মন্ত্রী হতে দেখেছি দেশের। সেই বৈরী সময়েও কিছু মানুষের ভালোবাসা প্রেরণা যোগাতো। সেই ভালোবাসার একটা বড় অংশ পেয়েছি ঢাকা মেডিকেলে। শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে,সিনিয়র,জুনিয়র, শিক্ষক সবার স্নেহ পেয়েছি। বাবার পরিচিত হাসপাতালের কর্মচারীরা আমার কাছে এসে কাঁদতেন বাবার কথা মনে করে। সবার এই ভালোবাসা সাহস যোগাতো আমাকে।

ঢাকা মেডিকেলে ছাত্রী থাকা অবস্থায় ‘প্রজন্ম একাত্তর’এর কাজের সাথে জড়াই। যুদ্ধে স্বজন হারানোর কষ্ট, শোক আমাদের একত্র করে। বিদেশে আসার আগ পর্যন্ত প্রজন্ম একাত্তরের কাজ করে গিয়েছি। সেই সময় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণঅাদালতের কাজ শুরু হয়। জাহানারা ইমামকে কাছ থেকে পাওয়াও একটা বড় অর্জন। শান্ত-শিষ্ট মানুষটা, অথচ দুচোখে যেন আগুন জ্বলছে। শোককে শক্তিতে পরিণত করার যে অবয়ব, সেটা তার মাঝে দেখেছি।

নব্বইয়ের আন্দোলনের সময় আমরা ক্যাম্পাসে কাটিয়েছি, মিলন স্যার (শহীদ ডাঃ শামসুল আলম খান মিলন) ছিলেন আমাদের শিক্ষক। উনি নিহত হওয়ার কিছুদিন পর, উনার স্ত্রী তার ছোট মেয়েটাকে নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন একদিন। মেয়েটাকে দেখার পর,লুকিয়ে কেঁদেছি অনেকক্ষণ। শুধু মনে হচ্ছিল, মেয়েটাকেও সেই একই কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

আমার আজকের যা অর্জন, তার পেছনে নব্বইভাগ অবদান আমার মায়ের। উনিও আরেক যোদ্ধা। উনত্রিশ বছরে স্বামীকে হারিয়েছেন। তখন থেকে দুই মেয়েকে নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন, তবে করুণা চাননি কখনো। আমাদের সবসময় বলতেন, বাবাকে নিয়ে,মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে। কষ্ট হতো মাঝে মাঝে, তবুও বলে যেতাম, মায়ের প্রেরণায়।

বাবা হারানোর কষ্ট, তাকে না পাওয়ার বেদনাকে ছাপিয়ে কাজ করে বাবাকে ঘিরে প্রচণ্ড এক গর্ব। জীবিত থাকতে যেখানে ছিলেন, সেখানেই কিছু না কিছু করে গেছেন। ঢাকা মেডিকেলের কথা আসলেই বলতেন বায়ান্নর ভাষা আন্দলোনের দিনগুলোর কথা। দুই বছর বয়সেই আমাদের শহীদ মিনারে নিয়ে যেতেন, মাকে বলতেন, “দেখো, ওরা কত ভাগ্যবান, দেশের জন্য শহীদ হতে পেরেছেন। তাই মনে হয় এখন, বাবা ভাগ্যবান, যেমন মৃত্যু চেয়েছিলেন, তেমনটাই পেয়েছেন। বিভিন্ন বইয়ে বাবার ছবি দেখি, আমার ছেলে মেয়েরা ডাকটিকিটে তাদের নানার ছবি দেখে অবাক হয়ে যায়। পতাকার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, ওই লাল রঙে কিছু অংশ হয়ত আমার বাবার।

তবু কষ্ট কাজ করে মাঝে মাঝে, যখন দেখি গণহত্যা নিয়ে, শহীদ বুদ্ধিজীবিদের হত্যা নিয়ে নিজের দেশেই ভুল তথ্য ছড়ানো হয়। যুদ্ধের মাঝে বাবা কেন সরকারি চাকরি করেছেন এ নিয়ে কটু কথা শুনতে হয়। অথচ, যুদ্ধের সময়, শুধু বাসায় না, গাড়িতে করে ওষুধ নিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিত়্সা দিয়েছেন। বেতিয়ারার যুদ্ধে প্রধান খরচ দিয়েছিলেন বাবা, এসব কথা বাবা বলেননি, আমরা অন্যদের থেকে জানতে পারি বাবা মারা যাওয়ার পর।

বুদ্ধিজীবি হত্যার দায়ে অভিযুক্ত দুজন যুদ্ধাপরাধীর মামলায় সাক্ষ্য দেই আমি। এটা নিয়েও কিছু মানুষ অপপ্রচার চালায় যে,তিন বছরের মেয়ের সাক্ষ্য নিচ্ছে। অথচ ওই মামলায় আমি ছিলাম hearsay witness, যেহেতু মা অন্য মামলায় সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন, তাই আমাকে মায়ের জবানীতে শোনা কথার সাক্ষ্য দিতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, শহীদদের নিয়ে এসব অপপ্রচার কষ্ট দেয়।

সবকিছুর পরেও, আমি কখনো ভাবিনি জীবিত অবস্থায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে পারবো। আল্লাহ সেই দিন আমাকে দেখিয়েছেন।

আর তোমরা যারা তরুণ প্রজন্ম, তোমাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।২০১৩ এর ফেব্রুয়ারিতে,সারা বাংলাদেশ থেকে মানুষ যখন শাহবাগে এসে স্লোগান দিলো- “বুকের ভেতর জ্বলছে আগুন, সারা বাংলায় ছড়িয়ে দে”, যে আগুন জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বয়ে নিয়ে চলছি, তাকে সবার মাঝে যখন জ্বলতে দেখেছি, তখন এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, আমরা কোনদিন হারিয়েও যাবোনা, হেরেও যাবোনা।

Dr. Farzana Choudhury
DMC K-45
Assistant Professor, USC Roski Eye Institute,California, USA
Elder Daughter of martyred intellectual Dr. Alim Chowdhury

***

লেখাটি humans of dmc এর ফেইসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত।

drferdous

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির পক্ষ থেকে শহীদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ

Mon Mar 27 , 2017
  স্বাধীনতার ৪৬তম বার্ষিকী উদযাপন করল বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটি। দিবসটির শুরুতে,সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পূস্পাজ্ঞ দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটি।   বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির সন্মানিত সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আবুল কাশেম স্যার ও সংগ্রামী মহাসচিব ডাঃ মোঃ হুমায়ুন কবীর বুলবুল স্যার এর নেতৃত্বে এসময় আরো উপস্থিত […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo