প্ল্যাটফর্ম নিউজ, রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২০
– ডা. সাঈদ এনাম
আমার সাথে যেভাবে পরিচয়ঃ
ডা. মঈন ভাইয়ের সাথে পরিচয় এর শুরু ১৯৯৪ সাল থেকে। সে সময় আমরা দু-তিনজন ক্লাসমেট এইচ. এস. সি পরীক্ষা দিয়ে সিলেট থেকে ঢাকা যাই মেডিকেল ভর্তি কোচিং করতে। সেখানে আমার বড় ভাইয়ের মাধ্যমে তাঁর সাথে পরিচয় হয়।
কোচিং এ মঈন ভাই আমাদের পড়িয়েছেন।মাঝেমধ্যে অবসর সময়েও উনি আমাদের ডেকে নিয়ে মেডিকেল কোচিং এর পড়া ধরতেন। কিভাবে পড়লে মেডিকেল নয় ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাওয়া যাবে সে পথ বাতলে দিতেন। মঈন ভাই ছিলেন অসম্ভব ধার্মিক মানুষ।
পরবর্তীতে আমার ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাওয়ায় মঈন ভাই খুব খুশি হন। আমার চেয়েও বেশি খুশি তিনি হন। হোস্টেলে একটা ভালো রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। দোতলায় চমৎকার একটা রুমে (১৩০) উঠে দেখি আমার রুমটি ঐ ব্লকের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর রুম। কিন্তু অবাক হলাম যখন দেখলাম মঈন ভাই এর নিজের থাকার রুমটা খুব একটা ভালো না, স্যাঁতসেঁতে। সেই তখন থেকেই মানুষটার প্রতি আমার আলাদা একটা সম্মান, শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি হয়।
আমাদের ব্যাচ কে -৫২ আর মঈন ভাই ছিলেন কে-৪৮ এর। ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ারে পড়াকালীন সময়ে কোন আইটেম (টপিক) না বুঝলে, উনার রুমে গিয়ে বুঝে আসতাম। সুন্দর করে, ধৈর্য্য সহকারে বুঝিয়ে দিতেন। পরীক্ষার সময় তিনি রুমে রুমে গিয়ে জুনিয়র দের খবর নিতেন। সাহস দিতেন।
এখনও মনে আছে, ফিজিওলজি বিষয়ের ব্লাড চ্যাপ্টারের একটি আইটেম ‘মেকানিজম অব হিমোস্টেসিস’ আর ‘ক্লটিং ফ্যাক্টর’ গুলো মাথায় ঢুকছিল না। মঈন ভাইয়ের রুমে গেলাম। তিনি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। হেসে হেসে বললেন, একটু আগে বদরুলও এসেছিলো।
শীতের সময় ডা. মঈন ভাই প্রায়শই সাদা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে থাকতেন। আহা! শুভ্র সফেদ চাদর গায়ে এতো ভালো, সাদাসিধে সিম্পল মানুষ আমি জীবনে দেখিনি।
কলেজ বা হোস্টেল ক্যান্টিনে আমরা মঈন ভাইকে কখনও আড্ডা দিতে পাইনি। তবে হোস্টেল মসজিদে তাঁকে আসরের নামাজের পর প্রায়ই বসে হাদিস পাঠরত অবস্থায় পেতাম। সবাইকে পড়াশোনায় বেশি
উৎসাহ দিতেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচিত, অপরিচিত জুনিয়র সবাই কে তিনি অসম্ভব স্নেহের চোখে দেখতেন। তাঁর সহপাঠী, বন্ধু, সিনিয়র সবার কাছে তিনি অসম্ভব বিশ্বস্ত আর কাছের মানুষ ছিলেন। এ এক ব্যতিক্রমী গ্রহন যোগ্যতা।
চাকুরী জীবনেঃ
চাকুরী জীবনে ওসমানীতে প্রায়ই দেখা হতো আমাদের সবার প্রিয়, সদা হাস্যজ্বল এই বড় ভাইটির সাথে।
আমি তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম সব সময়। মানুষ হিসাবে আমাদের অনেকের মধ্যে অনেক দূর্বলতা ছিলো বা থাকে, কিন্তু মঈন ভাই কে এমন একজন মানুষ হিসেবে দেখলাম যিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন ভালো মানুষ। কাজকর্ম, সরকারি দায়দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালনে তিনি ছিলেন বদ্ধ পরিকর। এটা অকপটে সবাই স্বীকার করেন।
আমি যখন ইউ.এইচ.এফ.পি.ও হিসেবে সিলেটের দক্ষিন সুরমায় জয়েন করি, তার কিছুদিন পূর্বে তিনি সেখান থেকে মেডিসিনের সহ অধ্যাপক হিসেবে প্রমোশন নিয়ে চলে আসেন ওসমানী মেডিকেলে। দক্ষিন সুরমা হেলথ কমপ্লেক্সে তাঁকে প্রায়ই রোগীরা এসে খুঁজতেন।
সিএইচসিপি, হেলথ এসিস্ট্যান্ট, হেলথ ইনচার্জ সবাই ‘মাসিক সমন্বয় সভায়’ আমাকে বলতেন, মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. মঈন স্যার প্রতিদিন আমাদের এখানে অনেক রোগী দেখতেন। তাছাড়াও তিনি মাঝেমধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক গুলোতে গিয়ে গরীব রোগীদের দেখতেন।
কনসালটেন্ট হয়ে প্রয়োজনে গাঁয়ের কমিউনিটি ক্লিনিক এ গিয়ে রোগী সেবা, এটা কেবল মঈন ভাইয়ের মতো দায়িত্ববান চিকিৎসকের পক্ষেই সম্ভব। রোগীদের সেই কমিউনিটি ক্লিনিকে আজো রোগীরা তাঁকে খুঁজে।
উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ হতে আমরা শ্রদ্ধেয় মঈন ভাইয়ের জন্যে এক অনাড়ম্বর বিদায় সম্বর্ধনা প্রদান করি। এই সম্বর্ধনা সভায় এসে মঈন ভাই বেশ আবেগ আপ্লুত বক্তব্য রাখেন।
আহা..! জন্মস্থল, কর্মস্থল সব জায়গায় গরীব রোগীদের নয়নের মনি ছিলেন আমাদের মঈন ভাই।
ডা. মঈন ভাই এই ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি তাঁর গ্রামের বাড়ি সিলেটের ছাতকে একটি ফ্রি মেডিকেল সেন্টার এ নিয়মিত রোগী দেখতেন।
আমি সাইকিয়াট্রিস্ট ছিলাম আবার ইউএইচএফপিও। তাই অবসরে আমাকে সাইকিয়াট্রির একটা চেম্বার সিলেট বিভাগীয় শহরে খোলার তাগাদা দিতেন। বলতেন, সাইকিয়াট্রি সাবজেক্ট খুব ডিমান্ডিং।
কিন্তু ইউএইচএফপিও কাজের ব্যস্ততার জন্যে পারছিলাম না। একদিন একটি এস.এম.এস দিলেন আমাকে চেম্বারের ব্যাপারে।
সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতির পর বললেন, এবার আর দেরি নয়, তাঁর পাশে একটা চেম্বার শুরু করতে হবে। তিনি সিলেট শহরের অত্যন্ত স্বনামধন্য একটি সেন্টারে বসতেন। সেখানে প্রায় অর্ধেক রোগী ফ্রি দেখতেন। একদিন তিনি বললেন, “তোমাকে ক’দিন আগে একটা ফোন নাম্বার এস এম এস দিয়েছিলাম, সেই নাম্বারে ফোন করে যোগাযোগ করবে আর আমার কথা বলবে।”
আমি খুশি হই আমার পূর্ব পরিচিত বড় ভাই তুল্য এমন একটা ভালো মানুষ, ভালো চিকিৎসকের পাশে আমি চেম্বার করতে পারবো বলে।
ওসমানী মেডিকেলের অধ্যাপক ‘টি’ রুমে দেখা হলেই মঈন ভাই বলতেন, ‘যোগাযোগ করেছো?,তাড়াতাড়ি চেম্বারে বসা শুরু করো, সিলেট বিভাগীয় শহরে একটা চেম্বার থাকা জরুরী। রোগীদের দরকার আছে, সাইকিয়াট্রি খুব ডিমান্ডিং… ”
একদিন ফোন দিলাম মঈন ভাইয়ের এস.এম.এস করা ঐ কনসালটেশন সেন্টারের নাম্বারে। একজন অবসর প্রাপ্ত কর্নেল ফোন ধরলেন। ধরেই উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললেন, “আরে সাহেব, ডা. মঈন সাহেব আপনার কথা সেই কবে বলছেন, আমিতো আপনার অপেক্ষা করছি…।”
মঈন ভাই সিলেট মেডিকেলের ডিএমসিয়ানদের অভিভাবকদের মতো ছিলেন। বিভিন্ন সময় মিটিং সিদ্ধান্ত আপডেট সবাইকে এস.এম.এস দিতেন।
মঈন ভাই এর সেই এস.এম.এস গুলো আমাদের কাছে এখন স্মৃতি। পড়তে গেলে চোখের জল আটকানো যায়না।
ডা. মঈন ভাই একজন আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ ছিলেন। দল, মত, ধর্ম নির্বিশেষে সবার কাছে তিনি ছিলেন অসম্ভব প্রিয়। যারা তাঁর সাহচর্যে এসেছে তারাই বলতে পারবে। এ মহৎ গুণবলী সবার মধ্যে পাওয়া যায় না। রাব্বুল আলামীন আমাদের সবার প্রিয় ডা. মঈন ভাই জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।
আমীন।