সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়ায় হার্টব্লকের চিকিৎসায় রিং (stent) এর অনৈতিক বাণিজ্য নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। এবং কিছু কিছু সাংবাদিক না জেনে না বুঝে এর দায়ভার চিকিৎসকদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। তাই এ বিষয়ে সাধারণ মানুষ যাতে প্রকৃত অবস্থা জানতে পারেন সেজন্য আজকের লেখা।
ক. নৈতিক ব্যবহার:
১। হার্টব্লক বলতে আমরা হার্টের ধমনীর (artery) ব্লক বুঝিয়ে থাকি। ধমনীর মাধ্যমে হার্টের মাংসপেশি অক্সিজেন ও খাদ্য পেয়ে থাকে। কোন ধমনী যদি হঠাৎ করে ( যেমন হার্ট এ্যাটাক) বন্ধ হয়ে যায় এবং ১২ ঘন্টার মধ্যে খুলে দেয়া না যায় তাহলে ঐ অংশের মাংসপেশি মৃত হয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে তা ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তবে যদি বুকে ক্রমাগত ব্যথা চলতে থাকে তাহলে বুঝতে হবে এখনো পেশি জীবিত আছে। অর্থাৎ হার্ট এ্যাটাক বা প্রায় এ্যাটাকের( unstable angina) জীবনরক্ষাকারী চিকিত্সা হল যত দ্রুত সম্ভব ব্লক খুলে দেয়া। হার্টের যত ব্লকের কথা আমরা শুনি তার মাত্র ১৫ থেকে ২০% হল এই ধরণের জীবনবিপন্নকারী ব্লক। এক্ষেত্রে শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে রিং ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ সময়ে ১টি রিং ই যথেষ্ট । এটা হল রিং এর নৈতিক ব্যবহার ।
২। হার্টের ধমনীর গাত্র (lumen) ধীরে ধীরে চর্বি জমে সরু হয়ে যেতে পারে। যখন তা ৭০% বা তার বেশি সরু হয় তখন পরিশ্রমের সাথে বুকে একধরণের ব্যথা বা চাপ অনুভূত হয়। বিশ্রাম নিলে ব্যথা কমে যায়। এটাকে বলে এ্যানজাইনা( chronic stable angina) যা এক বা একাধিক ধমনীতে হতে পারে। এটা একটি ক্রণিক রোগ যার প্রথম চিকিৎসা হল যথার্থ মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ। তবে angiogram করে দেখতে হবে কি ধরণের এবং কয়টি ব্লক আছে। হার্টব্লকের ৮০ থেকে ৮৫% ই হল এই ধরণের স্থিতিশীল(stable) ব্লক। অর্থাৎ এসব ব্লকের চিকিৎসায় রিং বা বাইপাস সার্জারী কোনটিই জরুরী নয়। যদি পর্যাপ্ত ওষুধ প্রয়োগ করবার পরেও উপসর্গ নির্মূল না হয় তাহলে ১ টি বা ২ টি ব্লক রিং এর মাধ্যমে অপসারণ করা যেতে পারে। তবে ৩ টা বা প্রধান ধমনীতে (Leftmain) ব্লক হলে ওপেন হার্ট সার্জারী ( bypass) করতে হবে। কিন্তু রোগীর শরীর যদি অপারেশনের উপযুক্ত না থাকে বা রোগী সার্জারী করতে না চান তাহলে সেক্ষেত্রে রিং লাগানো যেতে পারে। তবে ৩ টি ব্লক থাকলে কোনমতেই একই সঙ্গে (same sitting) রিং পরানো উচিত নয়। কার্ডিয়াক সার্জনের মতামত নিতে হবে এবং রোগীকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। এটাই হল রিং নৈতিক ব্যবহার ।
খ. অনৈতিক বাণিজ্য :
১। অন্যান্য পণ্যের মত রিং ও একটি বানিজ্যিক পণ্য। এটির উৎপাদন বিপণন তথা ক্রয় বিক্রয় পরিচালিত হয় মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়মে। এটির দেখভাল করা অর্থাৎ মান নিয়ন্ত্রণ, দাম নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কাজগুলোর জন্য সরকারের নির্দিষ্ট বিভাগ আছে। বাংলাদেশে রিং এর ব্যবহার সেই ১৯৯৬/৯৭ সাল থেকে হয়ে আসছে। এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এটি সরকারের নিয়মের মধ্যে থেকেই সরবরাহ করে আসছে। এতদিন তাহলে এর মান নিয়ন্ত্রণ দাম নিয়ন্ত্রণ কে করে আসছে? সরকারের ঔষধ প্রশাসন এতদিন ধরে কি করল? চিকিৎসক হিসেবে এসব প্রশাসনিক কাজ তো আমার পক্ষে করা সম্ভব নয় বা আমার আওতায়ও নেই। আমি তো রোগীর চিকিৎসায় মনোনিবেশ করব যথাযথভাবে। এখানে চিকিৎসক কোনভাবে রিং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন না। সেটা করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারী বিভাগ, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালসমূহ।
২। তবে আশার কথা সরকারের সংশিষ্ট বিভাগের নিদ্রা ভেঙ্গেছে। তারা রিং এর একটি ন্যায়সঙ্গত মূল্য নির্ধারণে উদ্যোগী হয়েছে। রোগীরা আমাদের কাছে আসেন উপযুক্ত চিকিৎসার আশায়। তাঁদের ভরসার জায়গাটা আমাদের উপর। তাই এবিষয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আগেই রিং এর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ( MRP) নির্ধারণের দাবী জানিয়ে আসছি।
সাশ্রয়ী এবং ন্যায়সংগত মূল্যে আধুনিক চিকিৎসা পাওয়া রোগীর নাগরিক এবং মানবিক অধিকার।
লিখেছেন, Mahbubor Rahman
MD, FACC, FRCP (Edin)
Senior Consultant Interventional Cardiologist,
Labaid Cardiac Hospital