ছবিটি সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি জেনারেল হসপিটালের জরুরি বিভাগের।
ছবিটির ঘোলাটে অংশে সারিবদ্ধভাবে বসে ডাক্তারের সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষায় আছে রোগীবৃন্দ। তাদের সমস্যা যাই হোক- পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা থেকে শুরু করে কাটা-ছেঁড়া সবাইকেই লাইনে থাকতে হবে৷
এখানে কোনটা চেয়ারম্যানের ভাতিজার শালাবাবু, ইউএনওর ড্রাইভারের বউ, শিল্পপতি আক্কাস আলীর একমাত্র আদরের দুলালি কন্যা – কোন কিছুই দেখার সুযোগ নেই। কোন হম্বিতম্বি চলবে না। চলবে না পেশাদারিত্বের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ।
সবাই অসুস্থ, অসুস্থ হলে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে থাকেন সবাই৷ তাই সবারই সমান কষ্ট৷ যার যার কষ্ট তার তার কাছে। প্রবাদ আছে – The wearer best knows where the shoe pinches.
Primary Healthcare এর মূলনীতি অনুযায়ী তার একটির হলো Equitable Distribution Of Health Resources. এর ব্যাখ্যা এটা নয় যে সবাই সমান পাবে। এর মানে হলো এই যে, ন্যায়সঙ্গত ও প্রাধিকার ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার। তবে হ্যাঁ, ডাক্তার তাঁর মেডিকেল জ্ঞানের আলোকে অসংখ্য রোগীর মাঝে বেশি জরুরি/জীবননাশের আশংকাজনক রোগীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখতে পারেন।
আমি বলতে পারি না আমার সিভিয়ার এপিগ্যাস্ট্রিক পেইন আপনার একিউট মাইগ্রেন এটাকের চেয়ে বেশি কষ্টকর। কারণ দুজনেই কষ্ট পাচ্ছি অসুখে৷ আমার ব্যথা পেটে, আপনার ব্যথা মাথায়৷ কিন্তু মানসিকভাবে আমরা বড়ই অধৈর্যশীল, অসহিষ্ণুতার পরিচয় দেই৷
সব ক্ষেত্রেই প্রভাব খাটানোর বদভ্যাস আমাদের ব্যক্তিগত ইমেজের ‘দৈন্যতা’ই প্রকাশ করে৷
এখন আসি ছবিটির সামনের ফোকাসড অংশের দিকে৷ সেখানে স্পষ্ট করে লেখা সামান্য (Mild) ও মোটামুটি গুরুতর (Moderate) সমস্যাগ্রস্ত রোগীদেরকে ডাক্তার দেখানোর জন্য মোটামুটিভাবে অনধিক ৫ ঘন্টা অপেক্ষায় থাকতেই হবে৷ রোগীরা চাইলে অপেক্ষা করবে অথবা বাইরের অন্য কোন ক্লিনিকে চলে যেতে পারে৷
এর মাঝে রোগীর অবস্থা যাই হোক না কেন, যদি মারাও যায় সে দায়িত্ব হাসপাতালের না৷ ডাক্তারের তো নয়ই।
আমি মোটাদাগে প্রশ্ন করতে চাই বাংলাদেশের কোন সরকারি হাসপাতালের সামনে এমন সাইনবোর্ড আছে যে আপনাকে এত এত ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে?
হল্ফ করে বলতে পারি একটাও পাবেন না৷
ডাক্তারকে এখানে খুবই সহজে দেখা পাওয়া যায়৷ অবশ্য মানুষের কাছে আজকাল ফার্মেসিওয়ালাই বড় ডাক্তার সেজে বসে আছে৷
ছবিটি দিয়ে এটাই বুঝাতে চাইছি, যারা কথায় কথায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত, চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে তিনবেলা পিণ্ডি চটকাতে ভালোবাসেন তাদের যেন চোখের পর্দা খোলে৷ অবশ্য এদেশে এখন বেশিরভাগ জনগণ অন্ধ হয়ে গিয়েছে আর অন্ধের দেশে আমরা (ডাক্তার) আয়না বেচার চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত।
আমাদের সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কি পরিমাণ চাপ থাকে তা নিরপেক্ষভাবে যাচাই না করলে লিখে বোঝানো সম্ভব না৷ এই তো কিছুদিন আগেও আমার নিজ মেডিকেল সোহরাওয়ার্দীতে আগুন লাগলো। ডাক্তার, ছাত্র-ছাত্রী, ইন্টার্ন চিকিৎসক, ওটিতে থাকা সার্জন, নার্স, ব্রাদার সবাই কতটা আন্তরিকতা ও উৎকন্ঠা নিয়ে রোগীদেরকে দ্রুত সরিয়ে নিলো কোন ধরনের প্রাণনাশের ঘটনা ছাড়াই৷ সেইদিনই রাত দুইটার দিকে হাসপাতালের ভর্তি কার্যক্রম সচল করা হয় এবং চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখা হয়৷
সাম্প্রতিককালে সংঘটিত বড়সড় দুর্ঘটনায় প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগ তাদের সবটুকু সাধ্য দিয়ে তড়িৎ গতিতে সেবা প্রদান করেছে তাদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও।
এটা তো শুধু একটা উদাহরণ টানলাম মাত্র৷ সারা দেশে প্রতি মুহুর্তে অসংখ্য রোগীকে জরুরিভাবে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন আমাদের ডাক্তাররা। জরুরি বিভাগে ট্রলি নেই, হুইল চেয়ার নেই, এসব ডাক্তারের দেখার বিষয় নয়৷ এসব প্রশাসনিক দায়িত্বের ভেতর পরে৷ মনে রাখবেন ডাক্তারের চিকিৎসা প্রদান স্বাস্থ্যসেবার একটি অংশ মাত্র। এর আরও আনুষঙ্গিক উপাদান রয়েছে। দুর্ভাগ্য আমাদের মানুষদেরকে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রদান করা সম্ভব হয়নি। স্কুলের পাঠ্যক্রমে প্রাথমিক জীবন দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করা গেলে অনেকটাই প্রাণহানি কমে যেতো।
কিছু হলেই ডাক্তারের গায়ে হাত তোলার জন্য যারা আসেন তাদেরকে বলবো, আপনারা মারতে থাকেন।
একদিন আপনারও হয়তো বা হৃদপিণ্ড হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দেবে৷ সেদিন আপনাকে সিপিআর দিলে হয়তো বেঁচে যেতেন৷ কিন্তু আমি দেবো না। রেফার করে দেবো। আপনি বাঁঁচবেন এই গ্যারান্টি কিন্তু কেউ দেয় না৷ আমিও বলছি না যে আপনি বেঁচে ফিরবেন। কিন্তু ফিরতেও পারেন….. কিন্তু আমি কেন খামোখা ঝুঁকি নেবো? ভাগ্যক্রমে যদি আপনি না ফিরেন আপনারই ছেলে আমার দিকে আঙুল তুলে বলবে ‘ডাক্তার আমার বাবার বুকে চেপে মেরে ফেললো’। কে জানে হয়তো বা লাঠির কয়েক ঘা আমার মাথাতেও পড়বে৷
আপনি প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে জরুরি বিভাগে আসলেন কটসন ইঞ্জেকশন দিলেই হয়তো বা বেঁচে যাবেন৷ কিন্তু আমি সেদিন হয়তো দেবো না। কারন আপনি মারা গেলে (আল্লাহ না করুক) আপনার আত্মীয়রা আমাকে মারতে আসবে এই বলে যে, ডাক্তার ইঞ্জেকশন দিয়ে রোগী মেরে ফেললো।
আমি কিন্তু রেফার করে দেবো। পথের মধ্যে মারা গেলে কাকে মারবেন? গাড়ির ড্রাইভারকে মারতে পারেন। এই বলে যে, বেটা তুই এত ধীরে গাড়ি চালিয়েছিস বলেই রোগী মারা গেলো!
আর প্রিয় সাংবাদিক ভাইদেরকে বলি না জেনে ভুলভাল তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে আপনারা চিকিৎসক ও রোগীর মাঝে বিভেদ বাড়াবেন না৷ আপনাদের জ্ঞাতিভাই যখন পেপারে লেখেন ‘এন্টিবায়োটিকেও দূর হচ্ছে না নতুন এক ধরনের ছত্রাক’ কিংবা ‘গাছের কান্ড (স্টেম সেল) থেকে কিডনিজনিত রোগীর চিকিৎসা আবিষ্কার’ তখন ডিউটির প্রচণ্ড চাপেও অট্টহাসি পেয়ে যায়। দয়া করে নিজেদেরকে এভাবে নিচে নামাবেন না৷
মার খাওয়ার চিন্তা আর রাজনৈতিক উটকো প্রেসার নিয়ে আর যাই হোক, সুচিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয়।
তাই আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে? আপনার ভবিষ্যৎ কেমন হবে….
মনে রাখবেন সব কিছুর পরেও
#We_are_committed_to_serve
মূল লেখক
আব্দুল্লাহ আল যুবাইর
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ
সেশনঃ ২০১৫-১৬
web reporter
Sumaiya Nargis
STAMC/Session 2016-17.