প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -২
হাসপাতালের ঈদ
ছোটবেলা থেকেই আমার ঈদ কেটেছে ঢাকায়। গলির মোড়ে দাড়িয়ে সাদা,কালো,বাদামী গরুর কোরবাণী দেখে কোরবাণীর ঈদ কেটেছে।
ঈদ মানেই ছিল বিশাল আনন্দ। সেই আনন্দও এখন নেই। সেই গলির মোড়ও নেই। কারণ এখন আমি আর ঢাকায় থাকি না।গতবছর মেডিকেলে চান্স পাবার পর আমার বাবার ইচ্ছায় আমরা বাসা চেঞ্জ করে চলে এসেছি গাজীপুর।
আমি রাফিদ,গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। হ্যা,এই মেডিকেল টা সরকারী। গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি উত্তর দিতে হয়েছে এটাই। মেডিকেলে পড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। আব্বু আম্মুর ইচ্ছায় ভর্তি হয়েছি। আমার পিছু পিছু আমার আব্বু আম্মুও চলে এসেছে গাজীপুর। সময় গড়িয়েছে, মেডিকেলে অনেক গুলো মাস চলে গেছে। একটু একটু ভালো লাগতে শুরু করেছে। গাজীপুরে এটা আমার দ্বিতীয় ঈদ। এইতো কয়দিন আগেই পার করলাম রোজার ঈদ। বন্ধুবান্ধব সবাই ঢাকায়। স্কুল,কলেজ, এলাকার ফ্রেন্ড তো বটেই, এমনকি মেডিকেলে এসে হওয়া নতুন বন্ধুগুলোরও বেশিরভাগেরই বাসা ঢাকায়। বন্ধুবান্ধব নাই, তাই ঈদ কাটিয়েছি বাসায় বসে মুভি দেখে। আগামীকাল আরেকটা দিন ঐভাবে কাটাতে হবে ভেবেই খারাপ লাগছে।
ঈদের দিন সকালবেলা নামাজে গেলাম। নামাজ শেষে সবাই কোলাকুলি করছে, আমি কাউকেই চিনি না। নামাজ শেষ করে চলে এলাম। রোজার ঈদের মতই মন খারাপ হয়ে গেল। ঢাকায় মসজিদে কোলাকুলি করতে করতে বাসায় আসতে দেরি হয়ে যেত। কোরবাণীর ঈদ বলে তাও বাচোয়া। দুপুর পর্যন্ত ব্যস্ত রইলাম কোরবাণী নিয়েই। নিজে জবাই না দিলেও মাংস বাসায় আসার আগ পর্যন্ত সব দেখাশোনা করতে হল।
দুপুরে খেয়ে শরীরটা বিছানায় একটু এলিয়ে দিলাম। মোবাইল টা হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলাম। ডাক্তার আর মেডিকেল স্টুডেন্টদের এক বিশাল গ্রুপ আছে। ৮৮০০০+ মেম্বার, প্ল্যাটফর্ম নাম। কয়েকজন ডাক্তার দেখলাম পোস্ট দিয়েছে, এই ঈদের দিনেও তাদের ডিউটি করতে হচ্ছে। দেখে অনেক খারাপ লাগল,মন খারাপ অনেকটাই কমে গেল। আমি তো তাও পরিবারের সাথে আছি,তারা তো তাও নাই। হঠাৎই মনে হল কথাটা। ঘুরতে যাওয়ার তো জায়গা নেই আমার। হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়। আরো কিছুক্ষণ শুয়ে রইলাম। দ্বিধাগ্রস্থ আমি, সাতপাচ ভেবে একটু পর উঠেই পড়লাম।
বাসা থেকে হাসপাতাল কাছেই, পাচ মিনিটের হাটাপথ। গেট দিয়ে ঢুকলাম। দুটো বিল্ডিং হাসপাতালের। একটা দোতলা পুরনো বিল্ডিং,এটা সদর হাসপাতাল ছিল। আরেকটা নতুন আটতলা বিল্ডিং,মেডিকেলে কলেজ হওয়ার পর হয়েছে। আমি পুরনো বিল্ডিং এ ঢুকলাম, মেডিসিন ওয়ার্ডে। হাসপাতাল হাসপাতালের মতই আছে। যেমনটা দেখি ওয়ার্ডের সময়। নার্সের টেবিলে একজন নার্স বসে বসে ফোনে কথা বলছে। রেজিস্ট্রার স্যার বোধহয় তার রুমে। আমি কিছুক্ষণ দাড়িয়ে দেখে চলে আসলাম। ঈদের দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকা মানুষগুলোর কি আনন্দ হয়? নাকি মন আরো বেশি খারাপ হয়? কিছুটা হয়তো হয়। কে জানে।
নতুন বিল্ডিং এ ঢুকলাম আমি। লিফট এ উঠলাম। আটতলায় সার্জারি ওয়ার্ডে যাব। নতুন হাসপাতালটা দেখলেই ভালো লাগে। সবকিছু ঝকঝকে তকতকে। একসময় এটাও পুরনোটার মত ময়লা হয়ে যাবে ভাবতেই খারাপ লাগে। সার্জারী ওয়ার্ডে গিয়েও দেখলাম একই অবস্থা। প্রত্যেক বেডেই রোগীর সাথে এক দুজন করে লোক। অনেকেই কিছু খাবার নিয়ে এসেছে বাসা থেকে রান্না করে,ঈদ বলে কথা। মন খারাপের মাঝেও এতটুকুই তো অনেক বড় আনন্দ।
২০ নম্বর বেডের পেশেন্টের দিকে চোখ পড়ল এদিক সেদিক তাকাতে গিয়ে। বুড়ো একটা লোক,চেহারাটা চেনা। সেদিন ওনার হিস্ট্রি নিয়েছিলাম। আশেপাশে সব বেডেই কেউ না কেউ আছে রোগীর সাথে, ওনার বেডে কেউ নাই। উনি শুয়ে আছেন, এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছেন। মনে পড়ল আমার, ওনার হিস্ট্রি যখন নিয়েছিলাম বলেছিলেন,কেউ নেই ওনার। ছেলেমেয়েরা সব দূরে থাকে। ওনার স্ত্রী মারা গিয়েছেন ১০ বছর আগে। একাই থাকেন এখানে। ছেলেমেয়েরা তেমন খোজ খবরও নেয় না।
গতকাল রাতেও খুব একা একা লাগছিল। মনে হচ্ছিল সারাদিন মুভি দেখে কাটানোর মত বোরিং কাজ আর কি আছে। আর আজ মনে হচ্ছে, আনন্দ,খুশি সব কিছুই আপেক্ষিক। হাসপাতালে ঈদ করা এই মানুষগুলোর কাছে সুস্থ হয়ে বাসায় ঈদ করতে পারাটাই হত সবচেয়ে বড় আনন্দ। আর সেটা পেরেও মনে আনন্দ আসে না আমাদের।
লেখকঃ জামিল সিদ্দিকী
শহীদ তাজউদ্দিন আহম্মেদ মেডিকেল কলেজ ।