প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৯ জুন ২০২০, শুক্রবার
ডা. মারুফ রায়হান খান
এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)
বসুন্ধরা কোভিড হসপিটাল।
১) করোনা আতঙ্কে এলো না কেউ, লাশ কাঁধে নিলেন চিকিৎসক। (দৈনিক আমাদের সময়)
২) করোনা সন্দেহে ঘরে বন্দি রাখে পরিবার, সেখানেই মৃত্যু। (যমুনা টিভি)
৩) করোনা সন্দেহে পিতাকে বস্তাবন্দী করে ফেলে গেল দুই ছেলে, কিছুক্ষণ পর মৃত্যু। (ইত্তেফাক)
৪) নিষ্ঠুরতা, বাবার লাশ ঢাকার পর গ্রামেও দাফনে বাঁধা, এগিয়ে এলেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। (জাগো নিউজ)
৫) করোনা আতঙ্কে এগিয়ে আসেনি কেউ, চার মেয়ের কাঁধে বাবার লাশ। (ইত্তেফাক)
৬) করোনা সন্দেহে মা কে সখীপুরের বনে ফেলে গেলেন সন্তানেরা। (প্রথম আলো)
৭) করোনা আতঙ্কে খাটের ওপর লাশ রেখে পালালেন স্বজনরা। (জাগো নিউজ)
৮) স্বজন ও পরিবারের কেউ এলেন না, স্বামীর মুখাগ্নি করলেন জজ স্ত্রী। (বাংলাদেশ প্রতিদিন)
৯) স্বজনরা এগিয়ে না আসায় মৃত ব্যক্তির সৎকার করলেন ইউএনও। (প্রথম আলো)
১০) দুই ছেলেই বাড়িতে রাখেননি বৃদ্ধা মাকে, এগিয়ে এলেন চিকিৎসক। (এনটিভি)
খুঁজতে গেলে অনেক অনেক পাওয়া যাবে। আমি শুধু প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের কয়েকটি শিরোনাম উল্লেখ করলাম।
হয়তো ৪০ বছর পর কেউ তার নাতি-নাতনীকে গল্প শোনাবে।
২০২০ সাল। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে সন্তান যেখানে মাকে ছোঁয় না, স্ত্রী ছোঁয় না স্বামীকে- তেমনই এক মহামারীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের সেবা করে যাচ্ছিলেন গরীবের ডাক্তার হিসেবে পরিচিত এক ‘পাগলাটে’ ডাক্তার। নাম তার ডা. আবদুর রকিব খান।
উচিত ছিল ‘পাগলাটে’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘বীর’ কিংবা ‘যোদ্ধা’ শব্দটি ব্যবহার করা। কিন্তু বাধ্য হয়ে ‘পাগলাটে’ শব্দটি ব্যবহার করতে হলো। কারণ যাদের জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছিলেন, তাদের হাতেই খুন হতে হয়েছে তাঁকে। যেনতেনভাবে না। মারতে মারতে মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাথার ভেতরটা রক্তে ভরে গিয়েছিল। সিটি স্ক্যানে দেখা গেছে তেমনটাই। প্রবল যন্ত্রণা নিয়ে তিনি মারা গেলেন। উনার কী দোষ ছিল? প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণে মারা গেছে নারী। প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণে বাংলাদেশ, ভারত কেন উন্নত বিশ্বেও বহু মা মারা যান। এ এমনই এক ক্রিটিক্যাল কন্ডিশান।
পরবর্তী প্রজন্ম নিশ্চয়ই বলে উঠবে, কী বোকা মানুষরে বাবা! কী দরকার ছিল এই ক্রাইসিসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আরেকজনের স্ত্রীর জটিল অপারেশান করার। বাসায় বসে থাকলেই হতো। একটা অপারেশান না করলে, তার এমন কী এসে যেতো।
তখন আরও পাগলাটে কিংবা বোকা ডাক্তারদের গল্পের ঝাঁপি খুলতে হবে। এই মারাত্নক ছোঁয়াচে রোগের বিস্তার কমানোর জন্য চিকিৎসকরা বলা শুরু করলেন, সাধারণ অসুখের জন্য আপনারা হসপিটাল বা চেম্বারে ভিড় করিয়েন না৷ তাহলে বিকল্প উপায় কী?
প্রফেসর থেকে ইন্টার্ন ডক্টর পর্যন্ত সবাই তাদের ফোন নাম্বার উন্মুক্ত করলেন৷ এই মহামারীতে নিজেদের বিলিয়ে দিলেন মানবতার তরে। যেন প্রয়োজনে মানুষ তাদের কাছে ফোন করে সেবা নেয়। কয় টাকা লাগবে ফোনে সেবা পেতে? এক টাকাও না। সবাই বিনামূল্যে সেবা দিচ্ছেন এই আন্তর্জাতিক দুর্যোগে। একজন ম্যাডাম ভিজিট চেয়েছিলেন অনলাইনে রোগী দেখতে। মানুষ তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে রাখেনি কিছু। মানুষ ধরে নিয়েছিল ডাক্তাররা তার গোলাম। বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতে বাধ্য৷ দোকানদার বোধহয় ডাক্তারকে আধা কেজি চাল, দুটো আলু ফ্রি দেয়। ডাক্তারের সন্তানদের বোধহয় স্কুল বিনামূল্যে পড়ায়। শপিং মলের আশেপাশে ঘুরলেই দোকানদাররা শার্ট, প্যান্ট বিনামূল্যে ছুঁড়ে মারে।
এই বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়া মানুষরাই বলা শুরু করলো, ডাক্তাররা ‘এক্সবেরিমেন’ চালানোর জন্য নাকি তাদের সেবা দিচ্ছে। যে মানুষটি ‘এক্সপেরিমেন্ট’ শব্দটি বানান করে লিখতে পারে না, সেও ডাক্তারদের চিকিৎসায় ভুল ধরে।
ডাক্তারদের চেম্বার হতে পারে ইনফেকশানের অনেক বড় একটা সোর্স। কারণ সেখানে অনেক মানুষের আনাগোনা। ডাক্তার একটা করোনা রোগী দেখে যদি আরেকজন অন্য রোগের মানুষকে দেখে তাহলে সেও আক্রান্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। বৃহৎ উদ্দেশ্যে চেম্বার বন্ধ হলো। মানুষ বলা শুরু করলো ডাক্তার পালিয়েছে। আগে বলতো, কেন চেম্বার করে? কেন এতো টাকা কামায়? এখন বলা শুরু করলো চেম্বার করে না কেন। অথচ সরকারি হাসপাতাল ২৪ ঘণ্টা খোলা ছিল।
ডাক্তার যে পালায়নি তা প্রমাণ করতে ইতোমধ্যে প্রায় ১২০০ চিকিৎসক আক্রান্ত। মারা গেছেন প্রায় ৪৫ জন স্বনামধন্য চিকিৎসক। প্রায় সবাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হতে কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়, তা জানে কেবল সে এবং তার মা-বাবা আর স্ত্রী-সন্তান। এতোকিছু করেও কিন্তু গালিগালাজ কম ছিল না।
ঈদের ছুটিতে পঙ্গপালের মতো মানুষ বাড়ি যায়। আবার আসে। আবার যায়। ফেরিতে তিল ধারণের জায়গা থাকে না৷ ১০/১৫ দিনের শিশু বাচ্চাকে মাথার উপর নিয়েই রওয়ানা হয়েছে৷ যেকোনো সময় ধাক্কাধাক্কিতে সন্তানটা মারা যাবে। এরাও নাকি সন্তানকে ভালোবাসে। রাস্তায় বের হলে, ১০০ জনে ১০ জন ঠিক করে মাস্ক পরে কি না সন্দেহ। প্রচুর রোগী তাদের ইতিহাস-লক্ষণ গোপন করে চিকিৎসা নিতে আসছিল। আক্রান্ত হচ্ছিল শয়ে শয়ে ডাক্তার। এসব ডাক্তাররা অসুস্থ তবুও দিনের একটা বড় অংশ আত্নীয়-স্বজন অমুক-তমুককে ফোনে আর মেসেঞ্জারে চিকিৎসা দিয়ে কাটাতো। অনেক লোক তাদের জিজ্ঞেসও করতো না, তারা কেমন আছে। অথচ বিনামূল্যে সার্ভিস নিতো। উনারা কেউ কেউ সুস্থ হতে থাকে। নিজের প্লাজমাতে এন্টিবডি তৈরি হয়। যে রোগীদের দ্বারা তারা আক্রান্ত, এমনই কোনো রোগীকে নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে দেয় অকাতরে। যদি একটা মানুষ বেঁচে যায়। এ পর্যন্ত কতোজন ডাক্তার নিজের রক্ত বের করে দিয়েছেন হিসেব রাখেন কি?
এদিকে প্রাইভেট হসপিটালগুলোতে ডাক্তার ছাঁটাই হচ্ছিল সমানে। বেতন কমা শুরু হয়ে গিয়েছিল ৪০-৫০%। বেকার হতে শুরু করেছিল তরুণ চিকিৎসকরা।
ডা. রোকসানা রহমান ম্যাডামকে একজন মারতে চেয়েছেন, তিনি চেম্বার না করায়। তাঁর মতো ডেডিকেটেড চিকিৎসক সারা বিশ্বে কমই আছেন। তিনি প্রথম থেকেই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন ফ্রন্টলাইনে থেকে। গত ৩ মাস ধরে নিজের মা এবং একমাত্র সন্তান থেকে দূরে আছেন। বুকটা কেমন ফেটে যায়, আপনারা যারা মা আছেন, যারা সন্তান আছেন তারা বুঝবেন। একটা মানুষ কোভিড ডেডিকেটেড ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেন, তিনি কি চেম্বার করে বেড়াবেন? তার কাছ থেকে কতো মানুষ আক্রান্ত হতে পারে, কেউ কি এটা বোঝে না?
সুপারস্প্রেডার শব্দটা বোঝেন? রোগীদের স্বার্থে তিনি চেম্বার বন্ধ রেখেছেন আর তাকেই কি না এক মহিলা খুন করতে চায়? এই জঘণ্য- কুৎসিত হৃদয়ের মানুষটিও মা হবে?
হায়রে বোকা ডাক্তার! মায়া হয় আপনাদের জন্য!