২৬ মার্চ, ১৯৭১। স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে এসে পৌঁছেছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে তখন চাঞ্চল্য, দ্বিধা, উত্তেজনা। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড, কেউ কেউ নিচ্ছেন সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি। তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চলছে অন্য এক প্রস্তুতি।
ইতিহাসে কল্পনা চলে না, তিনটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি এরপর পূর্ব ব্যখায় যাওয়া যাবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক বেলাল মোহাম্মদের জবানীতে-
“গাড়িবারান্দায়(বেতার ভবনের) আমাদের একজন মহিলা ঘোষিকা-তিনি একজন ভদ্রলোককে দেখিয়ে বলেছিলেনঃ বেলাল ভাই, ইনি আমার চাচা, ডাক্তার আনোয়ার-আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। ডাক্তার আনোয়ার বলেছিলেনঃ আচ্ছা, আপনারা বেতার চালু করে কি প্রচার করবেন, ঠিক করেছেন? আমি বলেছিলামঃ আগে চালু করার ব্যবস্থা করি, এরপর যা মুখে আসে বলবো। কথা তো সেই একটা, আমরা স্বাধীন। তিনি সাইক্লোস্টাইল করা একটি ক্ষুদ্রকায় ঘোষণাপত্র আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেনঃ এটা দেখুন তো! দুই বা তিন বাক্য বিশিষ্ট স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। পড়েই আমি উল্লসিত হয়েছিলাম। বলেছিলামঃ ভালোই হল। এটা দিয়ে অধিবেশন শুরু করা হবে, আর এর ভিত্তিতেই প্রচার করা হবে সকল বক্তব্য”।
(বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, পঞ্চম খণ্ড)
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুবুল হক ২৬ মার্চ, ২০১২তে প্রথম আলো পত্রিকায় “কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা” থেকে উদ্ধৃত, “২৭ মার্চের প্রথম অধিবেশন: ২৭ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ প্রতিরোধ কেন্দ্রের ছাত্রনেতারা বেতার চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। ছাত্রনেতাদের মধ্যে আলোচনাক্রমে মেডিকেল কলেজের মাহফুজুর রহমান, বেলায়েত হোসেন, আবু ইউসুফ চৌধুরী, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, পলিটেকনিক্যালের (ভিপি) আবদুল্লাহ আল হারুন, আজিজ, খুরশিদসহ অনেকে কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্রে যান। এ সময় ডা. এম এ মান্নান এমপিএ ও আবুল কাসেম সন্দীপ তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। বেতারকেন্দ্র চালু করে প্রথম ভাষণ দেন ডা এম এ মান্নান। এরপর সংবাদ পাঠ করেন শাহ-ই-জাহান চৌধুরী ও মাহফুজুর রহমান, ইংরেজি সংবাদ পাঠ করেন বেলায়েত হোসেন এবং মাহফুজুর রহমান সংবাদ বুলেটিন পড়েন। আবদুল্লাহ আল হারুন একটি ভাষণ দেন। সবশেষে ইউসুফ চৌধুরী একটি প্রতিবেদন পড়েন। এ অধিবেশনে দেশাত্মবোধক গানও প্রচার করা হয়। ঘণ্টা দু-তিনেক থাকার পর উদ্যোক্তারা শহরে যুদ্ধের অন্যান্য কাজে চলে যান। এ অধিবেশনে মেকানিক আবদুস শুকুরও উপস্থিত ছিলেন”।
“২৭ মার্চ বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে ডা. এম এ মান্নান, ডা। মাহফুজুর রহমান, রাখাল চন্দ্র বণিক বক্তৃতা দেন। খবর পাঠ করেন, ডা. মাহফুজুর রহমান, ডা. বোরহান(ইংরেজি) ও ডা. ইউসুফ”-তথ্য সূত্র স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে টেপ। (মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগরী ও প্রাসঙ্গিক বিষয় আশয়-সাথী দাশ)।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আমার বন্ধু তখনকার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র স্বাগত মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভূমিকা নিয়ে কিছু কাজ করেছিল। তাঁর সেই কাজের অন্যতম তথ্যসূত্র ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান। ডা. মাহফুজুর রহমান সর্বশেষ জানামতে চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার এলাকায় একটি ল্যাবে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি পুর্বাপর বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। সে সময়কার কোন স্মৃতি বা তথ্য মনে ছিল না, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৬১তম জন্মদিন উপলক্ষে আবার খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিছুদিন আগে অনুপম প্রকাশণীর কর্ণধার চট্টগ্রাম অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মিলন কান্তি নাথের সাথে আলাপচারিতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় চট্টগ্রাম মেডিকেলের ভুমিকার কথা উঠে এসেছিল।
এবার কল্পনা করা যাক। বেলাল সাহেবের হাতে ছাপার অক্ষরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র যা তৈরি করে দিয়েছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র-চিকিৎসকেরা। সরাসরি কোথাও লেখা নেই, জনাব বেলাল মোহাম্মদ ডা আনোয়ার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সেটিও কোথাও লেখেননি। কিন্তু পরের দিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ পুনরায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করার কথা আমরা জানতে পারি। তখনকার বিস্ফোরণমুখ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ২৬ ও ২৭ তারিখের ঘটনাবলী আরো বিস্তারিত পড়লে বোধগম্য হবে।
ভাবা যায় সেই অস্থির সময়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র নেতা চিকিৎসকদের প্রস্তুতি? বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হয়েছেন, ঢাকায় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ কেউ দ্বিধান্বিত, কেউ অস্ত্র বিতরণ করছেন, সেই সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণাটি ধারণ করে, সেটিকে তখনকার সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপিয়ে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণাপত্র তৈরি করে তাঁরা পথের ব্যারিকেড, হানাদার বাহিনীর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে বেতার কেন্দ্রে নিজ উদ্যোগে পৌঁছেছেন। কেবল পৌঁছেছেন ই না, তখনকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছেন। কেবল তাই নয় আগের দিন ২৬ তারিখ তিন বার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বিক্ষিপ্ত সম্প্রচারের পর এবং বেলাল মোহাম্মদের ভাষ্যমতে প্রতিবারের সম্প্রচারকারীরা পরে ফিরে আসেনি-এই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রতিরোধ কেন্দ্রে ছাত্রনেতারা পরের দিন সকালে দৃঢ়তার সাথে অধিবেশন পরিচালনা করেন।
স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে কেবল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজই নয়, বাংলাদেশের সকল ক্রান্তিলগ্নে চিকিৎসকেরা কঠিন সঙ্কল্প নিয়ে ভূমিকা রেখেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে কারফিউ, শহীদের লাশগুমের মাঝে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা সাঈদ হায়দার ভাষা শহীদদের প্রথম শহীদ মিনার নকশা করেন এবং ঢাকা মেডিকেলের ছাত্ররা সেটি তৈরি করার চেষ্টা করেন(প্রত্যক্ষদর্শীর জবানীতে সে লেখা অন্য কখনো), ৯০’এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদ ডা মিলনের আত্মত্যাগের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সকল শিক্ষক পদত্যাগ করেন। এরপর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদত্যাগের পর স্বৈরাচারের পতন ত্বরান্বিত হয়।
ইতিহাসের শিক্ষা জাতির প্রয়োজনে নেপথ্যে থেকেই চিকিৎসকেরা অবদান রেখেছেন। কেবল ক্রান্তিলগ্নেই না দিন রাত ২৪ ঘন্টা প্রতি মূহুর্তে দেশের প্রতিটি কোণে কোনো না কোনো চিকিৎসক এখনো দেশের ১৭ কোটি মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, চট্টগ্রাম মেডিকেলের কৃতি সন্তান, ইতিহাস ঐতিহ্য সহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে নিয়ে পরবর্তীতে ধারাবাহিক ভাবে লিখতে চাই।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে আমি গর্বিত।
……………………
ডাঃ মোহিব নীরব
চমেক, ৪৮ প্রজন্ম
স্বত্ব প্ল্যাটফর্ম